Monday 18 July 2022

বঙ্গ ভান্ডা‌রের জিম্মাদার [আজহারুল ইসলাম সোহাগ]

 






বঙ্গ ভান্ডা‌রের বি‌বিধ রতন

ক‌রে নিল কে? আপনার ক‌রে!

এত রতন কোথা গেল এখন?


কত উপমা, কতক কে ছাড়ি‌য়ে

শু‌নে‌ছি মোর জননী উপরে,

প‌রে শ‌ুনিলাম তলা ছিলনা তার,

তাই খে‌য়ে নিল যত ক‌ুমি‌রে।


আর কিছু কাল, দেখ‌বে উদ‌রে

জল ঢে‌লে ভর‌তে হ‌বে দুপু‌রে!

রা‌তের বেলা ঢে‌কে যা‌বে দি‌নের ক্লা‌ন্তি

উদ‌রে তখ‌নো জ্বল‌বেনা প্রশা‌ন্তি!


অ‌বোদ র‌য়ে গে‌লি তোরা

‌ভে‌বে‌ছিস, আ‌ছিত ভাল,

‌কে যা‌বে অন্যর ঢো‌ল বাজা‌তে।

এবার নি‌জের চামড়া দি‌য়ে ঢোল বানা।


শু‌নে‌ছি এত, ফো‌লে গেল ব‌ঙ্গের ভান্ডার,

আ‌মিও হয়ত মোটাতাজা হ‌য়ে‌ছি,

তাই তিন বেলা ঘাম ঝ‌রে গা‌ত্রে।

মা‌ঝে সা‌ঝে প্র‌তি গ‌হিন রা‌ত্রে।


আ‌মি হিস্যা চাই, কোথা যায়,

আমার ভান্ডা‌রের রতন?

আ‌মি জননী তোমার,

আমার দুগ্ধ তোমার।

আঁচল ধ‌রে যে দি‌য়ে‌ছে টান

‌সে কেম‌নে হয় মোর সন্তান?


ধ‌র্মের নাই কোন কা‌হিনী

‌যেথায় বাড়া‌বে হাত।

তু‌মি ক‌পোকাত,

‌মে‌নে নাও নইত ভা‌গো,

‌তোমার নাই ঠাই এ তল্লা‌টে

কারন তু‌মি আম।

তারা তোমায় তা‌চ্ছিল্য ক‌রে বলে।

অট্ট হা‌সির ছ‌লে।

আহ মে‌ঙ্গো পিপুল।


বড় রাঙ্গামা‌টিয়া আশু‌লিয়া

০৩ শ্রাবণ ১৪২৯

Sunday 15 May 2022

আফসোস [ আজহারুল ইসলাম সোহাগ ]

 

স্বাধীন দেশে আজ আমি

  করি পরাধিনের বাস,

আমি না হয় বাদ ই দিলাম

  দেশের হচ্ছে সর্বনাশ।


স্বাধীনতার স্বাদ আজ 

  পায়নিক আমি,

কিসের তরে রয়ে গেল

  অনুর্ভর জন্মভূমি?


স্বাধীনতার যুগ-যুগান্তে

  পাড়ি দিল দেশ,

তবুও রইল আগের মত

  সোনার বাংলাদেশ।

 ১১ চৈত্র ১৪১৯

‌লিচু বাগান, 


Saturday 25 July 2020

তেজ [ দেবব্রত সিংহ ]


তেজ দেবব্রত সিংহ , Tez dabobroto sign, azharul islam sohag


 আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’
কাগজওয়ালারা বইললেক,
“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?
তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।
তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”

টিভি আওলারা বললেক : তুমি খেতমজুরের মেয়ে তুমি
কি করে কামীন খাটে মাধ্যমিকে প্রথম হলে
সেটা তুমাকে বলতে হকে খুলে

পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-
সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার
কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,
হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক
তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখে
চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।
-একি স্বপন দেখছি নাকি-
স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।
কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।

আজ বাপ বেঁইচে থাইকলে
আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-
আমার বুকের ভিতর
যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।
সেটো দেখাইতে পাইত্থম।
আপনারা বইলছেন বটে
“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”
কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু
উঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।
বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…
আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।
যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি
“বিটি না মাটি’
ঠাকুমা বইলথক্,
পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’
গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্
“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।
শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে
আর এক কানে বার কইরে দিবি।’
তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।
ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।
মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা
চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।
মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।
আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম
ইতিহাস…
কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।
মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!
আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।
ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।
শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই
মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।
পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,
সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,
দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন
আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম
“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”
বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-
“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,
তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল
আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো
আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”
বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।
তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”
কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেড়োই চইলে আইলম।”
তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।
বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে
দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা
সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।
মা কুনো রা কাড়ে নাই।
আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে
গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা
ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।
আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।
বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে
মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –
যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।
শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।
বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।
তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,
তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।
যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই
নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।
এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।
না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”
আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,
কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে
কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…
তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে
আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।
‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে
বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,
হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,
“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,
তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।
তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে
তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।
– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।
শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,
আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–
এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“
তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,
ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,
ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।
গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।
আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-
“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা
যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’
মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।
গাঁয়ের সেই দেঘইর‍্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।
ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-
“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,
তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।
বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”
বইল্ লম –
“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।
আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন
অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“




তেজ দেবব্রত সিংহ | Tej Deb Broto Sing


Tuesday 21 July 2020

মা আমার ঠিকানা [আজহারুল ইসলাম সোহাগ]


মা আমার ঠিকানা কবিতা , আজহারুল ইসলাম সোহাগ, azharul islam sohag


আমার আ‌ঁখি জুড়ালো তবে, তোমার বদন হেরে,
ও মা- তুমি আমার ঠিকানা,
এই পৃথিবী মূল্য বিহীন তোমার পরশ ছাড়া,
ও মা- তুমি আমার ঠিকানা,
তোমার বুকেই ঠিকানা ।

যখন আমি বুঝতে শিখি তোমায় ছাড়া কিছু না দেখি,
মরণ আমায় ডাকবে যবে তু‌মিই রব‌ে ঠিকানা,
ও মা- তুমি আমার ঠিকানা,
তুমিই রবে ঠিকানা ।

যদি যন্ত্রণা হয় এই পৃথিবীর সকল কিছু ঘি‌রে;
 অশান্ত মন সান্তনা পায় তোমার নীড়ে, 
ও মা- তুমি আমার ঠিকানা,
তোমার মাঝেই ঠিকানা।

কথার মাঝে তোমায় আমি, কত কষ্ট দিতেম, মনের ভুলে।
ক্ষমা করো তু‌মি আমায় মা-গো,
ও মা- তুম‌ি আমার ঠিকানা,
তোমার পদতলে ঠিকানা,
ও মা ।

রড় রাঙ্গামিা‌টিয়া, আশু‌লিয়া।
০৬ শ্রাবণ ১৪২৭




মা আমার ঠিকানা আজহারুল ইসলাম সোহাগ | Ma amar thekana Azharul Islam Sohag








Monday 8 June 2020

পু‌টি মা‌ছের লাল শাড়ী [আজহারুল ইসলাম সোহাগ]

পু‌টি মা‌ছের লাল শাড়ী কবিতা , আজহারুল ইসলাম সোহাগ,

মন চায়‌ছে উ‌ড়ে যে‌তে আজ তাই‌তে,
র‌য়ে‌ছে বাধা মোর অদৃ‌ষ্টের পায় তে।
‌কু‌ড়ি বছর পার হল দেখা আর হয়না,
পু‌টি মা‌ছের লাল শাড়ী যেন গয়না।
বরষা আ‌সে সা‌থে নি‌য়ে মে‌ঘের গর্জন
‌রিম‌ঝিম বৃ‌ষ্টি চৌ‌দি‌কে শুরু হল বর্ষন,
ফস‌লের মাঠ বে‌য়ে স্রোত যায় নদী‌তে;
উৎসা‌হে মাছ নানান, দলব‌লে উজা‌তে।
বৃ‌ষ্টিরা থে‌মে যায়, তবে মা‌ঝে মা‌ঝে গর্জন;
মাছগু‌লো নিরুপায় বাঁধা প‌রে নির্জন।
ছুকড়ারা জাল নি‌য়ে চ‌লে ত‌বে মাঠ পা‌নে।
আইল কেটে জাল ফে‌লে ব‌সে থা‌কে এক ম‌নে।
বৃ‌ষ্টির পা‌নিরা নে‌মে যায় কলক‌লে;
মাছগু‌লো সা‌থে নি‌য়ে একদম ছলছ‌লে।
উৎসাহ থে‌মে যায় মাছগু‌লোর চঞ্চল,
য‌বে এ‌সে প‌রে জা‌লে হ‌য়ে যায় নিশ্চল।
উৎসব শেষ হয় বরষার আগম‌নে,
চার‌দি‌কে থৈয়‌থৈয় গ্রামখা‌নি যেন ক‌নে।
শাপলা শালুক আ‌সে বর্ষার ধা‌নের মা‌ঝে,
এভা‌বেই যুগান্তর, বে‌ঁচে আ‌ছি সকাল সা‌ঝে।
রড় রাঙ্গামিা‌টিয়া আশু‌লিয়া।
১৭ জৈষ্ঠ ১৪২৭

পু‌টি মা‌ছের লাল শাড়ী আজহারুল ইসলাম সোহাগ | Poti masar Lal Sari Azharul Islam Sohag

















Friday 15 May 2020

এক আল্লাহ জিন্দাবাদ [ কাজী নজরুল ইসলাম ]



উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ; 
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। 
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ, 
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ। 

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই; 
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই! 
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে, 
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে। 

ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে, 
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে। 
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী, 
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি। 

মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী, 
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী। 
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি। 
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি। 

উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার, 
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার! 
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব 
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব। 

হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়, 
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়। 
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি; 
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি। 

তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে, 
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে। 
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়, 
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়। 

যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই, 
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই। 
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই, 
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই। 

মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের, 
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের! 
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ, 
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ। 

পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো, 
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো। 
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে, 
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে। 

দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল 
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল। 
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়, 
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়! 

তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা, 
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা। 
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ, 
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ। 

বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে, 
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে। 
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন, 
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন। 

নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান 
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান! 
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ, 
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।




এক আল্লাহ জিন্দাবাদ কাজী নজরুল ইসলাম | ak Allaha Zindabd Kazi Nazrul Islam



Saturday 25 April 2020

কৃষকের ঈদ [কাজী নজরুল ইসলাম]

বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গরস্থানে।
হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত- কংকাল
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু- সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়।
থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তীর খাওয়া বুক, ঋণে- বাঁধা- শির, লুটাতে খোদার রাহে।

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু- পাঁজরের হাড়?
আসমান- জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে।
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর পুটে।
কৃষকের ঈদ!ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার।
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু- বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা- মসজিদে আশেপাশে।

কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
নিঙ্গাড়ি' কোরান হাদিস ও ফেকাহ, এই মৃতদের মুখে
অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে।
নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি,
হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি?
ফল বহিয়াছ, পাওনিক রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি,
লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।

আল্লা- তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান?
শক্তি পেলো না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান।
ঈমান! ঈমান! বল রাতদিন, ঈমান কি এত সোজা?
ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?

শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পুর্ণ যার ঈমান,
শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আসমান।
আল্লাহর নাম লইয়াছ শুধু, বোঝনিক আল্লারে।
নিজে যে অন্ধ সে কি অন্যরে আলোকে লইতে পারে?
নিজে যে স্বাধীন হইলনা সে স্বাধীনতা দেবে কাকে?
মধু দেবে সে কি মানুষে, যাহার মধু নাই মৌচাকে?

কোথা সে শক্তি- সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার
আবে- জমজম শক্তি- উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তি-হীন
হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন।
দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ
কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি,
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি।
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।

Saturday 18 April 2020

মাগো, ওরা বলে [ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ]


“কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজেন ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি
ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা, তুই কবে আসবি?
কবে ছুটি?”
চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

“মাগো ওরা বলে

সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা
তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে
কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ী ফিরবো।
লক্ষ্মী মা,
রাগ করো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।”

“পাগল ছেলে”,

মা পড়ে আর হাসে,
“তোর ওপরে রাগ করতে পারি!”
নারকেলের চিড়ে কোটে,
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,
এটা-সেটা
আরো কতো কি!
তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে
ক্লান্ত খোকা।

কুমড়ো ফুল

শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পড়েছে ডাঁটা,
পুঁই লতাটা নেতানো
“খোকা এলি?”
ঝাপ্সা চোখে মা তাকায়
উঠানে উঠানে
যেখানে খোকার শব
শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন

মার চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।
তারপর
দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে কখন আসে!

এখন

মার চোখে শিশির-ভোর
স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।

Tuesday 24 December 2019

দুই বিঘা জমি [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]



শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'
কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য -
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।

নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ -
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে -
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ -
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন -
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি -
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন -
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব -
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।'
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ -
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।

উমর ফারুক [কাজী নজরুল ইসলাম]


তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!
                     আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?
                     আবার লুটায়ে পড়ি।
'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।
উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু !
আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু !
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন !
সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি !
নওশার বেশে সাজাও বন্ধু মোদের পুনর্বার
খুনের সেহেরা পরাইয়া দাও হাতে বাঁধি হাতিয়ার !
দেখাইয়া দাও - মৃত্যু যেথায় রাঙা দুলহিন - সাজে
করে প্রতীক্ষা আমাদের তরে রাঙা রণভূমি মাঝে !
মোদের ললাট - রক্তে রাঙিবে রিক্ত সিঁথি তাহার,
দুলাব তাহার গলায় মোদের লোহু - রাঙা তরবার !
                     সেনানী ! চাই হুকুম !
সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ে মৃত্যু - বধুর ঘুম
টুটিয়াছে ঐ যক্ষ - কারায় সহে না ক' আর দেরি,
নকীব কন্ঠে শুনিব কখন নব অভিযান ভেরী !
নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যায় জামানার অভিশাপ,
তোমার তখতে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ !
মোরা "আসহাব - কাহাফে" র মতো দিবানিশা দিই ঘুম,
"এশা" র আজান কেঁদে যায় শুধু - নিঃঝুম নিঃঝুম !
                         কত কথা মনে জাগে,
চড়ি কল্পনা - বোররাকে যাই তের শ' বছর আগে
যেদিন তোমার প্রথম উদয় রাঙা মরু - ভাস্কর,
আরব যেদিন হ'ল আরাস্তা, মরীচিকা সুন্দর !
গোষ্ঠে বসিয়া বালক রাখাল মুহম্মদ সেদিন
বার বারে কেন হয়েছে উতলা ! কোথা বেহেশতী বীণ
বাজিতেছে যেন ! কে যেন আসিয়া দাঁড়িয়েছে তাঁর পিছে,
বন্ধু বলিয়া গলা জড়াইয়া কে যেন সম্ভাষিছে !
                       মানসে ভাসিছে ছবি -
হয়ত সেদিন বাজাইয়া বেনু মোদের বালক নবী
অকারণ সুখে নাচিয়া ফিরেছে মেষ - চারণের মাঠে !
খেলায়েছে খেলা বাজাইয়া বাঁশি মক্কার মরু - বাটে !
খাইয়াছে চুমা দুম্বা - শিশুরে জড়াইয়া ধরি' বুকে,
উড়ায়ে দিয়েছে কবুতর গুলি আকাশে অজানা সুখে !
সূর্য যেন গো দেখিয়াছে - তার পিছনের অমারাতি
রৌশন - রাঙা করিছে কে যেন জ্বালায়ে চাঁদের বাতি।
উঠেছিল রবি আমাদের নবী, সে মহা সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে !
কে বুঝিবে লিলা - রসিকের খেলা ! বুঝি ইঙ্গিতে তার
বেহেশত - সাথী খেলিতে আসিলে ধরায় পুনর্বার।
তোমার রাখাল - দোস্তের মেষ চরিত সুদূর গোঠে,
হেথা "আজনান" - ময়দানে তব পরান ব্যথিয়া ওঠে !
কেন কার তরে এ প্রাণ - পোড়ানি নিজেই জাননা বুঝি,
তোমার মাঠের উটেরা হারায়, তুমি তা দেখনা খুঁজি !
ইহারই মাঝে বা হয়ত কখন দুঁহুঁ দোঁহা দেখেছিলে,
খেজুর - মোতির গল - হার যেন বদল করিয়া নিলে,
হইলে বন্ধু মেষ - চারণের ময়দানে নিরালায়,
চকিত দেখায় চিনিল হৃদয় চির - চেনা আপনায় !
খেলার প্রভাত কাটিল কখন, ক্রমে বেলা বেড়ে চলে,
প্রভাতের মালা শুকায়ে ঝরিল খর মরু - বালুতলে।
দীপ্ত জীবন - মধ্যাহ্নের রৌদ্র - তপ্ত পথে
প্রভাতের সখা শত্রুর বেশে আসিলে রক্ত - রথে।
আরবে সেদিন ডাকিয়াছে বান, সেদিন ভুবন জুড়ি,
"হেরা" - গুহা হ'তে ঠিকরিয়া ছুটি মহাজ্যোতি বিচ্ছুরি' !
প্রতীক্ষমাণ তাপসী ধরণী সেদিন শুদ্ধস্নাতা
উদাত্ত স্বরে গাহিতেছিল গো কোরানের সম - গাথা !
পাষাণের তলে ছিল এত জল, মরুভূমে এত ঢল ?
সপ্ত সাগর সাত শত হ'য়ে করে যেন টলমল !
খোদার হাবিব এসেছে আজিকে হইয়া মানব - মিতা,
পুণ্য - প্রভায় ঝলমল করে ধরা পাপ - শঙ্কিতা।
সেদিন পাথারে উঠিল যে মৌজ তাহারে শাসন - হেতু
নির্ভিক যুবা দাঁড়াইলে আসি ধিরি' বিদ্রোহ - কেতু !
উদ্ধত রোষে তরবারি তব উর্ধ্বে আন্দোলিয়া
বলিলে, "রাঙ্গাবে এ তেগ মুসলমানের রক্ত দিয়া !"
উন্মাদ বেগে চলিলে ছুটিয়া ! - একি একি ওঠে গান ?
এ কোন লোকের অমৃত মন্ত্র ? কার মহা আহ্বান ?
ফাতেমা - তোমার সহোদরা - গাহে কোরান - অমিয় - গাথা,
এ কোন মন্ত্রে চোখে আসে জল, হায় তুমি জান না তা' !
উন্মাদ - সম কেঁদে কও, "ওরে, শোনা পুনঃ সেই বাণী !
কে শিখাল তোরে এ গান সে কোন বেহেশত হ'তে আনি'
এ কি হল মোর ? অভিনব এই গীতি শুনি' হায় কেন
সকল অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিছে আবেশ যেন !
কি যেন পুলক কি যেন আবেগে কেঁপে উঠি বারে বারে,
মানুষের দুখে এমন করিয়া কে কাঁদিছে কোন পারে ? 
"আশহাদু আল - লা - ইলাহা ইল্লাল্লাহু" বলি'
কহিল ফাতেমা - "এই সে কোরান, খোদার কালাম গলি',
নেমেছে ভুবনে মুহম্মদের অমর কন্ঠে ভাই !
এই ইসলাম, আমরা ইহারি বন্যায় ভেসে যাই !"
উমর আনিল ঈমান। -গরজি' গরজি' উঠিল স্বর
গগণ পবন মন্থন করি' - "আল্লাহু আকবর !"
সম্ভ্রমে-নত বিশ্ব সেদিন গাহিল তোমার স্তব -
"এসেছেন নবী, এত দিনে এল ধরায় মহামানব !"
পয়গম্বর নবী ও রসুল - এঁরা তো খোদার দান !
তুমি রাখিয়াছ, হে অতি - মানুষ, মানুষের সম্মান !
কোরান এনেছে সত্যের বানী, সত্য দিয়াছে প্রাণ,
তুমি রূপ - তব মাঝে সে সত্য হয়েছে অধিষ্ঠান।
ইসলাম দিল কি দান বেদনা - পীড়িত এ ধরনীরে,
কোন নব বানী শুনাইতে খোদা পাঠাইলো শেষ নবীরে, -
তোমারে হেরিয়া পেয়েছি জওয়াব সে সব জিজ্ঞাসার।
কী যে ইসলাম, হয়ত বুঝিনি, এইটুকু বুঝি তার
উমর সৃজিতে পারে যে ধর্ম, আছে তার প্রয়োজন !
ওগো, মানুষের কল্যাণ লাগি' তারি শুভ আগমন
প্রতীক্ষায় এ দুঃখিনী ধরা জাগিয়াছে নিশিদিন
জরা - জর্জর সন্তানে ধরি' বক্ষে শান্তিহীন !
                      তপস্বিনীর মত
তাহারি আশায় সেধেছে ধরনী অশেষ দুখের ব্রত।
ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'
পাওনি ক' "ওহি", হওনি ক' নবী, তাই তো পরান ভরি'
বন্ধু ডাকিয়া আপনার বলি বক্ষে' জড়ায়ে ধরি !
খোদারে আমরা করি গো সিজদা, রসূলে করি সালাম,
ওঁরা উর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম।
তোমারে স্মরিতে ঠেকাই না কর ললাটে ও চোখে - মুখে,
প্রিয় হয়ে তুমি আছ হতমান মানুষ জাতির বুকে।
করেছ শাসন অপরাধীদের তুমি করনি ক' ক্ষমা,
করেছ বিনাশ অসুন্দরের। বলনি ক' মনোরমা
মিথ্যাময়ীরে। বাঁধনি ক' বাসা মাটির উর্ধ্বে উঠি।
তুমি খাইয়াছ দুঃখীর সাথে ভিক্ষার ক্ষুদ খুঁটি !
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।
                     হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি
একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'
                     ...ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'
                     খলিফা হাসিয়া বলে,
'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে
করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'
কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।
আরাম সুখের, - মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,
কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা।
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।'
আসিলে প্যালেস্টাইন, পারায়ে দুস্তর মরুভূমি,
ভৃত্য তখন উটের উপরে, রশি ধ'রে চল তুমি !
জর্ডান নদী হও যবে পার, শত্রুরা কহে হাঁকি -
"যার নামে কাঁপে অর্ধ পৃথিবী, এই সে উমর নাকি ?"
খুলিল রুদ্ধ দুর্গ - দুয়ার ! শত্রুরা সম্ভ্রমে
কহিল - "খলিফা আসেনি, এসেছে মানুষ জেরুজালেমে !"
সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি' শত্রু - গির্জা - ঘরে
বলিলে, "বাহিরে যাইতে হইবে এবার নামাজ তরে !"
কহে পুরোহিত, "আমাদের এই আঙ্গিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায় ?"
হাসিয়া বলিলে, "তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক সমাজ
ভাবিবে - খলিফা করিছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি'
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি !
ইসলামের এ নহে ক' ধর্ম, নহে খোদার বিধান,
কারো মন্দির গির্জারে করে ম'জিদ মুসলমান !"
কেঁদে কহে যত ঈসাই ইহুদী অশ্রু - সিক্ত আঁখি -
"এই যদি হয় ইসলাম - তবে কেহ রহিবে না বাকি,
                         সকলে আসিবে ফিরে
গনতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে !"
তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালিদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
ধরাধাম ছাড়ি' শেষ নবী যবে করিল মহাপ্রয়াণ,
কে হবে খলিফা - হয়নি তখনো কলহের অবসান,
নবী - নন্দিনী বিবি ফাতেমার মহলে আসিয়া সবে
করিতে লাগিল জটলা - ইহার পরে কে খলিফা হবে।
বজ্রকন্ঠে তুমিই সেদিন বলিতে পারিয়াছিলে -
"নবীসূতা ! তব মহল জ্বালাব, এ সভা ভেঙ্গে না দিলে।"
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।
শুনিয়া সকলি - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'।
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা !
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে !
                     এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান !
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'
                     আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।
বন্ধু গো, প্রিয়, এ হাত তোমারে সালাম করিতে গিয়া
ওঠে না উর্ধ্বে, বক্ষে তোমারে ধরে শুধু জড়াইয়া !
                             মাহিনা মোহররম -
হাসান, হোসেন হয়েছে শহীদ, জানে শুধু হায় কৌম,
শহীদি বাদশা' ! মোহররমে যে তুমিও গিয়েছ চলি'
খুনের দরিয়া সাঁতারি' - এ জাতি গিয়াছে গো তাহা ভুলি' !
মোরা ভুলিয়াছি, তুমি ত ভোলনি ! আজো আজানের মাঝে
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে বন্ধু তোমারি কাঁদন বাজে।
বন্ধু গো জানি, আমাদের প্রেমে আজো ও গোরের বুকে
তেমনি করিয়া কাঁদিছ হয়ত কত না গভীর দুখে।
ফিরদৌস হ'তে ডাকিছে বৃথাই নবী পয়গম্বর,
মাটির দুলাল মানুষের সাথে ঘুমাও মাটির 'পর।
হে শহীদ ! বীর ! এই দোয়া কর আরশের পায়া ধরি' -
তোমারি মতন মরি যেন হেসে খুনের সেহেরা পরি' !
মৃত্যুর হাতে মরিতে চাহিনা, মানুষের প্রিয় করে
আঘাত খাইয়া যেন গো আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়ে !